পরিচিতি :
আল্লাহ পাকের রসুলের প্রতিনিধি, আফযালুন্নাছ বা’দাল আম্বিয়া (নবীদের পরে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব), ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উনার প্রকৃত নাম আবদুল্লাহ, উপনাম আবূ বকর। বিশেষ উপাধি আতীক্ব ও ছিদ্দীক্ব্ব। পিতার নাম উছমান, উপনাম আবূ কুহাফা। মাতার নাম উম্মুল খাইর সালমা বিনতে সখর। তিনি ‘আমুল ফীল’ (আবরাহার হস্তী বাহিনী আগমনের বৎসর)-এর আড়াই বছর পরে ৫৭২ ঈসায়ী সনে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার প্রায় দু’বছর চার মাসের ছোট ছিলেন।
ইসলাম গ্রহণ :
ইসলাম গ্রহণকারী বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে তিনিই প্রথম। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সাথে সম্পর্কের দিক থেকে উনার পূর্ব পুরুষ মুর্রাহ-এর দিক দিয়ে তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার স্ব-বংশীয় ছিলেন। নবুয়ত প্রকাশের পূর্বেই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে উনার সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। স্বভাব চরিত্রের সাদৃশ্যের ফলে উনাদের সম্পর্ক এতই গভীর হয়ে উঠেছিল যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যহ সকালে এবং বিকালে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব্ব আলাইহিস সালাম-এর গৃহে অবশ্যই গমন করতেন। নবুয়ত প্রকাশের পরেও হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কী জীবনে প্রায় এক যুগ পর্যন্ত এই রীতি বিদ্যমান ছিল। (বুখারী শরীফ)
এ ছাড়া তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার নিকট স্বীয় মেয়েকে হাদিয়া দেন। আত্মীয়তার বন্ধন অপেক্ষা দ্বীনি সম্পর্কটাই উনাকে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সার্বক্ষণিক সহচর হিসাবে আটকিয়ে রেখেছিল।
খিলাফতের স্তম্ভ গ্রহণ:
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার বিছাল শরীফের সময় উনার অসুস্থ অবস্থায় হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম ১৭ ওয়াক্ত নামাযে ইমামতি করেছিলেন। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিছাল শরীফ বড় বড় ছাহাবাদিগকেও অভিভূত করে। এমনকি হযরত উমর ফারুক্ব আলাইহিস সালামও উনার বিছাল শরীফের খবর বিশ্বাস করতে পারেননি। তিনি উন্মুক্ত তরবারী হাতে বলতে লাগলেন, যে বলবে যে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার বিছাল শরীফ সম্পন্ন হয়েছে আমি তাকে এই তরবারী দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করব।
হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উনাকে শান্ত করতে সমর্থ হলেন। তিনি কুরআন শরীফের এই বাণী পড়ে শুনালেন, ‘‘মুহম্মদ (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ পাক-উনার রসূল, উনার পূর্বেও রসূলগণ বিগত হয়েছেন। সুতরাং যদি তিনি বিছাল শরীফ লাভ করেন অথবা শাহাদাত লাভ করেন তবে তোমরা কি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে? কেহ যদি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে সে আল্লাহ পাক-উনার কিছুই ক্ষতি করে না এবং আল্লাহ পাক কৃতজ্ঞগণকে পুরুস্কৃত করবেন’’।
হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উনার এই আয়াত শরীফ পাঠের সঙ্গে সঙ্গে ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের চেতনা ফিরে আসে। হযরত উমর ফারুক্ব আলাইহিস সালাম পর্যন্ত মন্তব্য করেছেন, আমার নিকট মনে হল- এই আয়াত শরীফগুলি এই মাত্র নাযিল হয়েছে। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিছাল শরীফ-এর পর ছাহাবায় কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ অনতিবিলম্বে সর্ব সম্মতিক্রমে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব্ব আলাইহিস সালাম উনার উপর খিলাফতের ভার অর্পন করলেন। অত:পর তিনি সমগ্র মুসলিম জাহানের খলীফা নিযুক্ত হন এবং যোগ্যতা ও সুনামের সাথে খিলাফতের স্তম্ভে সর্বমোট দু’বছর তিন মাস দশ দিন খিলাফত পরিচালনা করেন। এই অল্প সময়ের মধ্যে সকল প্রকার বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্র সাফল্যের সাথে দমন করে তিনি সমগ্র মুসলিম জাহানে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। সুবহানাল্লাহ।
ক্বওল শরীফ ও আমলঃ
মুসলমানের প্রত্যেক কষ্টের ছওয়াব দেয়া হবে। কাঁটা ফুটলে, এমনকি জুতার ফিতা ছিঁড়ে গেলেও মু’মিন তার ছওয়াব পাবে। যে ব্যক্তি আল্লাহ পাক-উনার খালিছ মুহব্বতের স্বাদ পেয়েছে, সেই আস্বাদন শক্তি তাকে দুনিয়ার স্বাদ তালাশ করা হতে বিরত রেখেছে। হক্ব কথা বলা খুবই কঠিন, কিন্তু তা কঠিন সত্ত্বেও আনন্দদায়ক ও প্রশংসনীয়। বাতিল কাজ সহজ হলেও তা নিন্দনীয়।
আয় আল্লাহ পাক! হক্বকে হক্ব অনুসারেই আমাকে দেখান, তাকে অনুসরণ করার তওফিক দিন বাতিলকে বাতিলরূপেই আমাকে দেখান এবং তাকে পরিত্যাগ করার তওফিক দিন। বাতিলকে আমার উপর বিজয়ী করে দিবেন না, যাতে আমি খাহেশ ও কু-প্রবৃত্তির দাস হয়ে পড়ি। (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দিয়া মুজাদ্দেদীয়া)
যে ব্যক্তি ঈদে মীলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনুষ্ঠানের জন্য এক দিরহাম খরচ করবে, সে জান্নাতে আমার বন্ধু হবে। (আন-নি‘মাতুল কুবরা আলা’ল ‘আলাম)
‘মুহীত’ কিতাবে উল্লেখ আছে যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (একবার) মসজিদে তাশরীফ এনে একটি স্তম্ভের নিকট বসেছিলেন। উনার পাশে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম বসেছিলেন। এর মধ্যে হযরত বিলাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আযান শুরু করেছিলেন, যখন ‘‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রসুলুল্লাহ’’ উচ্চারণ করলেন, তখন হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয়ের নখ্ চুম্বন করে আপন দু’চোখের উপর রেখে বললেন, কুর্রাতু ‘আইনী বিকা ইয়া রসুলাল্লাহ (হে আল্লাহ পাক-উনার রসুল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি আমার চোখের মণি)। হযরত বিলাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর আযান শেষ হওয়ার পর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম! আপনি যা করেছেন, যে ব্যক্তি তদ্রুপ করবে, আল্লাহ পাক তার সমুদয় গুণাহ্ মাফ করে দিবেন। (সুবহানাল্লাহ) (তাফসীরে রুহুল বয়ান)
বিছাল শরীফঃ
হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উনার অন্তিম সময়ে উনার নিকট উপস্থিত লোকেরা উনাকে জিজ্ঞেস করল, আপনার জন্য চিকিৎসক ডাকার ব্যবস্থা করব কি? তিনি বললেন, আমার চিকিৎসক আমাকে পরীক্ষা করে বলেছেন- নিশ্চয়ই আমি যা ইচ্ছা তাই করি। এ সময় হযরত সালমান ফারসী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে দেখতে আসলেন। অসুখের খোঁজ খবর নেয়ার পর তিনি বললেন, হে আবূ বকর! আমাকে কিছু ওছীয়ত করুন!
হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম বললেন, আল্লাহ পাক আপনাদের জন্য দুনিয়া জয় করে দিবেন। আপনি দুনিয়া থেকে প্রয়োজন পরিমাণই গ্রহণ করবেন। আর মনে রাখবেন, যে ব্যক্তি ফযরের নামায আদায় করে, সে আল্লাহ পাকের ওয়াদার মধ্যে থাকে। সুতরাং আল্লাহ পাকের সঙ্গে ওয়াদা ভঙ্গ করবেন না। যদি আল্লাহ পাকের সঙ্গে ওয়াদা ভঙ্গ করেন, তবে উপুড় অবস্থায় দোজখে নিক্ষিপ্ত হতে হবে। লোকেরা উনার অন্তিম সময়ে উনাকে অনুরোধ করল যে, একজনকে আপনার স্থলাভিষিক্ত করে দিন।
তিনি যখন হযরত উমর ফারুক্ব আলাইহিস সালামকে উনার স্থলাভিষিক্ত করলেন। তারা বলল, আপনি একজন কঠোর স্বভাব বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বকে আপনার স্থলাভিষিক্ত করেছেন। আপনি আল্লাহ পাকের নিকট এর কি জবাব দিবেন?
তিনি উত্তর দিলেন- আমি বলব, আল্লাহ পাক আপনার সৃষ্টির মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তিকেই আমি নিজের স্থলাভিষিক্ত করেছি। অতঃপর তিনি হযরত উমর ফারুক্ব আলাইহিস সালামকে ডেকে কিছু ওছীয়ত করলেন। (কিতাবু জিক্রিল মাউতি ওয়া মা বা’দাহু)
উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম সূত্রে আল-ওয়াক্বিদী এবং আল-হাকিম বর্ণনা করেন যে, হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম ৭ ই জুমাদাল উখ্রা সোমবার গোসল করেন। আর এই দিনটি ছিল শীতল। এর পর ১৫ দিন ধরে উনার জর হয়। এ সময় তিনি মসজিদে জামায়াতে নামায পড়তে পারেননি। হিজরী ১৩ সনে ২২ শে জুমাদাল উখ্রা মুতাবিক ২৩ শে আগস্ট, ৬৩৪ ঈসায়ী মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ৬৩ বছর বয়সে তিনি বিসাল শরীফ গ্রহণ করেন। (তারিখুল খুলাফা, কিতাবুল আলক্বাব, ৩য় খন্ড )
বুযুর্গী ও ফযীলতঃ
উনার বুযুর্গী ও ফযীলত বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। স্বভাবগত ভাবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কোমল প্রকৃতির লোক। কিন্তু শরীয়তের বিধান কার্যকর করার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। কালামুল্লাহ শরীফে স্বয়ং আল্লাহ পাক একাধিক স্থানে উনার ছানা-ছীফত করেছেন। উনার প্রশংসায় অসংখ্য হাদীছ শরীফ বর্ণিত হয়েছে। মুদ্দা কথা, নবী রসুল আলাইহিমুস সালামগণের পরে যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী তিনিই ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম এবং এই ছিদ্দীক্বে আকবর লক্বব উনার একক বৈশিষ্ট্য। উনার মর্যাদা স্বল্প পরিসরে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। এমন কোন ভাষা নেই, যে ভাষায় উনার জীবনী গ্রন্থ রচিত হয়নি। তিনি ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন, প্রথম কুরআন শরীফ সংগ্রহ করেন এবং নাম দিলেন মুছহাফ এবং তিনিই প্রথম যাঁকে খলীফা বলে অভিহিত করা হয়েছে।
হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম ইসলাম জগতে এক নজির-বিহীন বিরল ব্যক্তিত্ব। নুবুওওয়াতের পর উনার ইমামত ও খিলাফত সকলেই বিনা দ্বিধায় মেনে নেন। হাদীছ শরীফে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যেই জামায়াতে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উপস্থিত থাকবেন সেখানে তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইমামতি করা উচিত হবে না। (তিরমিযী শরীফ)
তিনি আরো ইরশাদ করেন, আমি আমার রব (আল্লাহ পাককে) ছাড়া যদি আর কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম তাহলে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালামকেই বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম। (মুয়াত্তা শরীফ)
মুয়াত্তা শরীফে আরো বর্ণিত হয়েছে, একদা জনৈক মহিলা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার নিকট এসে কোন বিষয়ে কথাবার্তা বলল। তিনি তাকে পুণরায় আসতে বললেন, তখন মহিলাটি বলল- ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি আবার এসে যদি আপনাকে না পাই, তখন কি করব? উত্তরে তিনি বললেন, তুমি যদি আমাকে না পাও, তবে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উনার নিকট এস। রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তিনি আমার (ছওর) গুহার সঙ্গী এবং হাউযে কাউছারে আমার সাথী। (তিরমীযী শরীফ)
নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার ছওর গুহার সঙ্গী হওয়ার বিষয়টি মহান আল্লাহ পাক উনার কালাম পাকে উল্লেখ করেছেন। এর ফযীলত বর্ণনা প্রসঙ্গে স্বয়ং হযরত উমর ফারুক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, আমার সারা জীবনের আমল যদি হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর সেই রাত্রির আমলের সমান হত! তা সেই রাত্রি, যেই রাত্রিতে তিনি (হিজরতের সফরে) হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সঙ্গে ছওর গুহার দিকে রওয়ানা হন। (রযীন)
হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উনার সবকিছু আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার জন্য কুরবান করে উম্মতের জন্য কিয়ামত পর্যন্ত এক উজ্জল আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। তাবুকের জিহাদের সময় চরম আর্থিক অনটন সত্ত্বেও তিনি উনার সকল গৃহ সামগ্রী হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সামনে নিয়ে উপস্থিত করেন। সন্তান সন্ততির জন্য কি রেখে এসেছেন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন যে, আল্লাহ পাক ও উনার রসুলকে রেখে এসেছি। (আবূ দাউদ শরীফ)
হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম ছিলেন একজন ধনী ব্যবসায়ী। যেদিন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, সেদিন উনার বাড়ীতে চল্লিশ হাজার দিরহাম বা দিনার ছিল, আর হিজরতের সময় যখন তিনি মদীনা শরীফ রওয়ানা হন, তখন উনার নিকট পাঁচ হাজার দিনার বা দিরহামের অধিক ছিল না। এই সব অর্থ তিনি গোলাম আযাদ ও দ্বীন ইসলামের জন্য ব্যয় করেছিলেন। (তারীখুল খুলাফা)
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যিনি সকল মানুষের মধ্যে আমাকে প্রাণ ও সমপদ দিয়ে সর্বাধিক দায়বদ্ধ করে ফেলেছেন, তিনি হলেন হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম। আমি যদি আমার রব (আল্লাহ পাক) ছাড়া অন্য কোন বন্ধু গ্রহণ করতাম, তবে নিশ্চয়ই সে হত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম। কিন্তু মুমিনদের ভ্রাতৃত্বই আমার জন্য যথেষ্ট। (তারীখুল খুলাফা)
তরীক্বতের ইমাম হযরত দাতা গঞ্জে বখ্শ রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ পাক কাউকে যখন পূর্ণ সততা দান করেন, তখন তিনি সর্বক্ষণ আল্লাহ পাকের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকেন এবং আল্লাহ পাক তাকে যখন যে অবস্থায় রাখেন তাতেই সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। যদি ফকীর হওয়ার নির্দেশ দেন, অমনি অম্লান বদনে ফকীর হয়ে যান। আর যদি আমীর হওয়ার নির্দেশ দেন তবে আমীর হয়ে যান। তিনি আপাদমস্তক আল্লাহ পাকের নির্দেশের সম্মুখে মাথা নত করে দেন। এই অবস্থাই ছিল হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালামের। এমনকি তিনি ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, উনার দ্বারা কোন অন্যায় কাজ সংঘটিত হলে কেউ যেন উনার অনুগত না থাকে। এই কারণে তিনি তরীক্বতের স্বয়ং সমপূর্ণ ইমাম ছিলেন। (কাশফূল মাহযুব)
হযরত মাওলানা শাহ আবদুল আজিজ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কিতাব “তোহ্ফায়ে ইছ্না আশারিয়া’’ কিতাবে লিখেছেন- হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ পাক যা কিছু আমার হূদয়ে নিক্ষেপ করেছেন, আমি তৎসমুদয় হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উনার হ্নদয়ে নিক্ষেপ করেছি। (তাছাউফ তত্ত্ব)
নক্শবন্দীয়া-মুজাদ্দিদীয়া তরীকার নিসবত উনার মাধ্যমেই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সাথে সম্পর্কিত।
তথ্যসূত্র সমূহঃ তারিখূল খোলাফা, কিতাবুল আলক্বাব, কাশফুল মাহযূব, জামেউ কারামাতে আওলিয়া, তফসীরে মাজহারী, হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া, কিতাবু জিকরিল মাওত ওয়ামা বা‘দাহু, সীরত গ্রন্থসমূহ।
আল্লাহ পাকের রসুলের প্রতিনিধি, আফযালুন্নাছ বা’দাল আম্বিয়া (নবীদের পরে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব), ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উনার প্রকৃত নাম আবদুল্লাহ, উপনাম আবূ বকর। বিশেষ উপাধি আতীক্ব ও ছিদ্দীক্ব্ব। পিতার নাম উছমান, উপনাম আবূ কুহাফা। মাতার নাম উম্মুল খাইর সালমা বিনতে সখর। তিনি ‘আমুল ফীল’ (আবরাহার হস্তী বাহিনী আগমনের বৎসর)-এর আড়াই বছর পরে ৫৭২ ঈসায়ী সনে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার প্রায় দু’বছর চার মাসের ছোট ছিলেন।
ইসলাম গ্রহণ :
ইসলাম গ্রহণকারী বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে তিনিই প্রথম। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সাথে সম্পর্কের দিক থেকে উনার পূর্ব পুরুষ মুর্রাহ-এর দিক দিয়ে তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার স্ব-বংশীয় ছিলেন। নবুয়ত প্রকাশের পূর্বেই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে উনার সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। স্বভাব চরিত্রের সাদৃশ্যের ফলে উনাদের সম্পর্ক এতই গভীর হয়ে উঠেছিল যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যহ সকালে এবং বিকালে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব্ব আলাইহিস সালাম-এর গৃহে অবশ্যই গমন করতেন। নবুয়ত প্রকাশের পরেও হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কী জীবনে প্রায় এক যুগ পর্যন্ত এই রীতি বিদ্যমান ছিল। (বুখারী শরীফ)
এ ছাড়া তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার নিকট স্বীয় মেয়েকে হাদিয়া দেন। আত্মীয়তার বন্ধন অপেক্ষা দ্বীনি সম্পর্কটাই উনাকে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সার্বক্ষণিক সহচর হিসাবে আটকিয়ে রেখেছিল।
খিলাফতের স্তম্ভ গ্রহণ:
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার বিছাল শরীফের সময় উনার অসুস্থ অবস্থায় হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম ১৭ ওয়াক্ত নামাযে ইমামতি করেছিলেন। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিছাল শরীফ বড় বড় ছাহাবাদিগকেও অভিভূত করে। এমনকি হযরত উমর ফারুক্ব আলাইহিস সালামও উনার বিছাল শরীফের খবর বিশ্বাস করতে পারেননি। তিনি উন্মুক্ত তরবারী হাতে বলতে লাগলেন, যে বলবে যে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার বিছাল শরীফ সম্পন্ন হয়েছে আমি তাকে এই তরবারী দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করব।
হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উনাকে শান্ত করতে সমর্থ হলেন। তিনি কুরআন শরীফের এই বাণী পড়ে শুনালেন, ‘‘মুহম্মদ (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ পাক-উনার রসূল, উনার পূর্বেও রসূলগণ বিগত হয়েছেন। সুতরাং যদি তিনি বিছাল শরীফ লাভ করেন অথবা শাহাদাত লাভ করেন তবে তোমরা কি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে? কেহ যদি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে সে আল্লাহ পাক-উনার কিছুই ক্ষতি করে না এবং আল্লাহ পাক কৃতজ্ঞগণকে পুরুস্কৃত করবেন’’।
হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উনার এই আয়াত শরীফ পাঠের সঙ্গে সঙ্গে ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের চেতনা ফিরে আসে। হযরত উমর ফারুক্ব আলাইহিস সালাম পর্যন্ত মন্তব্য করেছেন, আমার নিকট মনে হল- এই আয়াত শরীফগুলি এই মাত্র নাযিল হয়েছে। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিছাল শরীফ-এর পর ছাহাবায় কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ অনতিবিলম্বে সর্ব সম্মতিক্রমে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব্ব আলাইহিস সালাম উনার উপর খিলাফতের ভার অর্পন করলেন। অত:পর তিনি সমগ্র মুসলিম জাহানের খলীফা নিযুক্ত হন এবং যোগ্যতা ও সুনামের সাথে খিলাফতের স্তম্ভে সর্বমোট দু’বছর তিন মাস দশ দিন খিলাফত পরিচালনা করেন। এই অল্প সময়ের মধ্যে সকল প্রকার বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্র সাফল্যের সাথে দমন করে তিনি সমগ্র মুসলিম জাহানে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। সুবহানাল্লাহ।
ক্বওল শরীফ ও আমলঃ
মুসলমানের প্রত্যেক কষ্টের ছওয়াব দেয়া হবে। কাঁটা ফুটলে, এমনকি জুতার ফিতা ছিঁড়ে গেলেও মু’মিন তার ছওয়াব পাবে। যে ব্যক্তি আল্লাহ পাক-উনার খালিছ মুহব্বতের স্বাদ পেয়েছে, সেই আস্বাদন শক্তি তাকে দুনিয়ার স্বাদ তালাশ করা হতে বিরত রেখেছে। হক্ব কথা বলা খুবই কঠিন, কিন্তু তা কঠিন সত্ত্বেও আনন্দদায়ক ও প্রশংসনীয়। বাতিল কাজ সহজ হলেও তা নিন্দনীয়।
আয় আল্লাহ পাক! হক্বকে হক্ব অনুসারেই আমাকে দেখান, তাকে অনুসরণ করার তওফিক দিন বাতিলকে বাতিলরূপেই আমাকে দেখান এবং তাকে পরিত্যাগ করার তওফিক দিন। বাতিলকে আমার উপর বিজয়ী করে দিবেন না, যাতে আমি খাহেশ ও কু-প্রবৃত্তির দাস হয়ে পড়ি। (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দিয়া মুজাদ্দেদীয়া)
যে ব্যক্তি ঈদে মীলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনুষ্ঠানের জন্য এক দিরহাম খরচ করবে, সে জান্নাতে আমার বন্ধু হবে। (আন-নি‘মাতুল কুবরা আলা’ল ‘আলাম)
‘মুহীত’ কিতাবে উল্লেখ আছে যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (একবার) মসজিদে তাশরীফ এনে একটি স্তম্ভের নিকট বসেছিলেন। উনার পাশে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম বসেছিলেন। এর মধ্যে হযরত বিলাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আযান শুরু করেছিলেন, যখন ‘‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রসুলুল্লাহ’’ উচ্চারণ করলেন, তখন হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয়ের নখ্ চুম্বন করে আপন দু’চোখের উপর রেখে বললেন, কুর্রাতু ‘আইনী বিকা ইয়া রসুলাল্লাহ (হে আল্লাহ পাক-উনার রসুল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি আমার চোখের মণি)। হযরত বিলাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর আযান শেষ হওয়ার পর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম! আপনি যা করেছেন, যে ব্যক্তি তদ্রুপ করবে, আল্লাহ পাক তার সমুদয় গুণাহ্ মাফ করে দিবেন। (সুবহানাল্লাহ) (তাফসীরে রুহুল বয়ান)
বিছাল শরীফঃ
হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উনার অন্তিম সময়ে উনার নিকট উপস্থিত লোকেরা উনাকে জিজ্ঞেস করল, আপনার জন্য চিকিৎসক ডাকার ব্যবস্থা করব কি? তিনি বললেন, আমার চিকিৎসক আমাকে পরীক্ষা করে বলেছেন- নিশ্চয়ই আমি যা ইচ্ছা তাই করি। এ সময় হযরত সালমান ফারসী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে দেখতে আসলেন। অসুখের খোঁজ খবর নেয়ার পর তিনি বললেন, হে আবূ বকর! আমাকে কিছু ওছীয়ত করুন!
হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম বললেন, আল্লাহ পাক আপনাদের জন্য দুনিয়া জয় করে দিবেন। আপনি দুনিয়া থেকে প্রয়োজন পরিমাণই গ্রহণ করবেন। আর মনে রাখবেন, যে ব্যক্তি ফযরের নামায আদায় করে, সে আল্লাহ পাকের ওয়াদার মধ্যে থাকে। সুতরাং আল্লাহ পাকের সঙ্গে ওয়াদা ভঙ্গ করবেন না। যদি আল্লাহ পাকের সঙ্গে ওয়াদা ভঙ্গ করেন, তবে উপুড় অবস্থায় দোজখে নিক্ষিপ্ত হতে হবে। লোকেরা উনার অন্তিম সময়ে উনাকে অনুরোধ করল যে, একজনকে আপনার স্থলাভিষিক্ত করে দিন।
তিনি যখন হযরত উমর ফারুক্ব আলাইহিস সালামকে উনার স্থলাভিষিক্ত করলেন। তারা বলল, আপনি একজন কঠোর স্বভাব বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বকে আপনার স্থলাভিষিক্ত করেছেন। আপনি আল্লাহ পাকের নিকট এর কি জবাব দিবেন?
তিনি উত্তর দিলেন- আমি বলব, আল্লাহ পাক আপনার সৃষ্টির মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তিকেই আমি নিজের স্থলাভিষিক্ত করেছি। অতঃপর তিনি হযরত উমর ফারুক্ব আলাইহিস সালামকে ডেকে কিছু ওছীয়ত করলেন। (কিতাবু জিক্রিল মাউতি ওয়া মা বা’দাহু)
উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম সূত্রে আল-ওয়াক্বিদী এবং আল-হাকিম বর্ণনা করেন যে, হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম ৭ ই জুমাদাল উখ্রা সোমবার গোসল করেন। আর এই দিনটি ছিল শীতল। এর পর ১৫ দিন ধরে উনার জর হয়। এ সময় তিনি মসজিদে জামায়াতে নামায পড়তে পারেননি। হিজরী ১৩ সনে ২২ শে জুমাদাল উখ্রা মুতাবিক ২৩ শে আগস্ট, ৬৩৪ ঈসায়ী মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ৬৩ বছর বয়সে তিনি বিসাল শরীফ গ্রহণ করেন। (তারিখুল খুলাফা, কিতাবুল আলক্বাব, ৩য় খন্ড )
বুযুর্গী ও ফযীলতঃ
উনার বুযুর্গী ও ফযীলত বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। স্বভাবগত ভাবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কোমল প্রকৃতির লোক। কিন্তু শরীয়তের বিধান কার্যকর করার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। কালামুল্লাহ শরীফে স্বয়ং আল্লাহ পাক একাধিক স্থানে উনার ছানা-ছীফত করেছেন। উনার প্রশংসায় অসংখ্য হাদীছ শরীফ বর্ণিত হয়েছে। মুদ্দা কথা, নবী রসুল আলাইহিমুস সালামগণের পরে যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী তিনিই ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম এবং এই ছিদ্দীক্বে আকবর লক্বব উনার একক বৈশিষ্ট্য। উনার মর্যাদা স্বল্প পরিসরে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। এমন কোন ভাষা নেই, যে ভাষায় উনার জীবনী গ্রন্থ রচিত হয়নি। তিনি ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন, প্রথম কুরআন শরীফ সংগ্রহ করেন এবং নাম দিলেন মুছহাফ এবং তিনিই প্রথম যাঁকে খলীফা বলে অভিহিত করা হয়েছে।
হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম ইসলাম জগতে এক নজির-বিহীন বিরল ব্যক্তিত্ব। নুবুওওয়াতের পর উনার ইমামত ও খিলাফত সকলেই বিনা দ্বিধায় মেনে নেন। হাদীছ শরীফে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যেই জামায়াতে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উপস্থিত থাকবেন সেখানে তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইমামতি করা উচিত হবে না। (তিরমিযী শরীফ)
তিনি আরো ইরশাদ করেন, আমি আমার রব (আল্লাহ পাককে) ছাড়া যদি আর কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম তাহলে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালামকেই বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম। (মুয়াত্তা শরীফ)
মুয়াত্তা শরীফে আরো বর্ণিত হয়েছে, একদা জনৈক মহিলা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার নিকট এসে কোন বিষয়ে কথাবার্তা বলল। তিনি তাকে পুণরায় আসতে বললেন, তখন মহিলাটি বলল- ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি আবার এসে যদি আপনাকে না পাই, তখন কি করব? উত্তরে তিনি বললেন, তুমি যদি আমাকে না পাও, তবে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উনার নিকট এস। রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তিনি আমার (ছওর) গুহার সঙ্গী এবং হাউযে কাউছারে আমার সাথী। (তিরমীযী শরীফ)
নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার ছওর গুহার সঙ্গী হওয়ার বিষয়টি মহান আল্লাহ পাক উনার কালাম পাকে উল্লেখ করেছেন। এর ফযীলত বর্ণনা প্রসঙ্গে স্বয়ং হযরত উমর ফারুক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, আমার সারা জীবনের আমল যদি হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর সেই রাত্রির আমলের সমান হত! তা সেই রাত্রি, যেই রাত্রিতে তিনি (হিজরতের সফরে) হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সঙ্গে ছওর গুহার দিকে রওয়ানা হন। (রযীন)
হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উনার সবকিছু আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার জন্য কুরবান করে উম্মতের জন্য কিয়ামত পর্যন্ত এক উজ্জল আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। তাবুকের জিহাদের সময় চরম আর্থিক অনটন সত্ত্বেও তিনি উনার সকল গৃহ সামগ্রী হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সামনে নিয়ে উপস্থিত করেন। সন্তান সন্ততির জন্য কি রেখে এসেছেন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন যে, আল্লাহ পাক ও উনার রসুলকে রেখে এসেছি। (আবূ দাউদ শরীফ)
হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম ছিলেন একজন ধনী ব্যবসায়ী। যেদিন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, সেদিন উনার বাড়ীতে চল্লিশ হাজার দিরহাম বা দিনার ছিল, আর হিজরতের সময় যখন তিনি মদীনা শরীফ রওয়ানা হন, তখন উনার নিকট পাঁচ হাজার দিনার বা দিরহামের অধিক ছিল না। এই সব অর্থ তিনি গোলাম আযাদ ও দ্বীন ইসলামের জন্য ব্যয় করেছিলেন। (তারীখুল খুলাফা)
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যিনি সকল মানুষের মধ্যে আমাকে প্রাণ ও সমপদ দিয়ে সর্বাধিক দায়বদ্ধ করে ফেলেছেন, তিনি হলেন হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম। আমি যদি আমার রব (আল্লাহ পাক) ছাড়া অন্য কোন বন্ধু গ্রহণ করতাম, তবে নিশ্চয়ই সে হত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম। কিন্তু মুমিনদের ভ্রাতৃত্বই আমার জন্য যথেষ্ট। (তারীখুল খুলাফা)
তরীক্বতের ইমাম হযরত দাতা গঞ্জে বখ্শ রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ পাক কাউকে যখন পূর্ণ সততা দান করেন, তখন তিনি সর্বক্ষণ আল্লাহ পাকের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকেন এবং আল্লাহ পাক তাকে যখন যে অবস্থায় রাখেন তাতেই সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। যদি ফকীর হওয়ার নির্দেশ দেন, অমনি অম্লান বদনে ফকীর হয়ে যান। আর যদি আমীর হওয়ার নির্দেশ দেন তবে আমীর হয়ে যান। তিনি আপাদমস্তক আল্লাহ পাকের নির্দেশের সম্মুখে মাথা নত করে দেন। এই অবস্থাই ছিল হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালামের। এমনকি তিনি ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, উনার দ্বারা কোন অন্যায় কাজ সংঘটিত হলে কেউ যেন উনার অনুগত না থাকে। এই কারণে তিনি তরীক্বতের স্বয়ং সমপূর্ণ ইমাম ছিলেন। (কাশফূল মাহযুব)
হযরত মাওলানা শাহ আবদুল আজিজ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কিতাব “তোহ্ফায়ে ইছ্না আশারিয়া’’ কিতাবে লিখেছেন- হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ পাক যা কিছু আমার হূদয়ে নিক্ষেপ করেছেন, আমি তৎসমুদয় হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উনার হ্নদয়ে নিক্ষেপ করেছি। (তাছাউফ তত্ত্ব)
নক্শবন্দীয়া-মুজাদ্দিদীয়া তরীকার নিসবত উনার মাধ্যমেই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সাথে সম্পর্কিত।
তথ্যসূত্র সমূহঃ তারিখূল খোলাফা, কিতাবুল আলক্বাব, কাশফুল মাহযূব, জামেউ কারামাতে আওলিয়া, তফসীরে মাজহারী, হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া, কিতাবু জিকরিল মাওত ওয়ামা বা‘দাহু, সীরত গ্রন্থসমূহ।