বুধবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৪

খলীফাতু রসূলিল্লাহ হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উনার সংক্ষিপ্ত জীবনী মুবারক

পরিচিতি :
আল্লাহ পাকের রসুলের প্রতিনিধি, আফযালুন্নাছ বা’দাল আম্বিয়া (নবীদের পরে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব), ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উনার প্রকৃত নাম আবদুল্লাহ, উপনাম আবূ বকর। বিশেষ উপাধি আতীক্ব ও ছিদ্দীক্ব্ব। পিতার নাম উছমান, উপনাম আবূ কুহাফা। মাতার নাম উম্মুল খাইর সালমা বিনতে সখর। তিনি ‘আমুল ফীল’ (আবরাহার হস্তী বাহিনী আগমনের বৎসর)-এর আড়াই বছর পরে ৫৭২ ঈসায়ী সনে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার প্রায় দু’বছর চার মাসের ছোট ছিলেন।

ইসলাম গ্রহণ :

ইসলাম গ্রহণকারী বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে তিনিই প্রথম। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সাথে সম্পর্কের দিক থেকে উনার পূর্ব পুরুষ মুর্‌রাহ-এর দিক দিয়ে তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার স্ব-বংশীয় ছিলেন। নবুয়ত প্রকাশের পূর্বেই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে উনার সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। স্বভাব চরিত্রের সাদৃশ্যের ফলে উনাদের সম্পর্ক এতই গভীর হয়ে উঠেছিল যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যহ সকালে এবং বিকালে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব্ব আলাইহিস সালাম-এর গৃহে অবশ্যই গমন করতেন। নবুয়ত প্রকাশের পরেও হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কী জীবনে প্রায় এক যুগ পর্যন্ত এই রীতি বিদ্যমান ছিল। (বুখারী শরীফ)

এ ছাড়া তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার নিকট স্বীয় মেয়েকে হাদিয়া দেন। আত্মীয়তার বন্ধন অপেক্ষা দ্বীনি সম্পর্কটাই উনাকে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সার্বক্ষণিক সহচর হিসাবে আটকিয়ে রেখেছিল।

খিলাফতের স্তম্ভ গ্রহণ:
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার বিছাল শরীফের সময় উনার অসুস্থ অবস্থায় হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম ১৭ ওয়াক্ত নামাযে ইমামতি করেছিলেন। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিছাল শরীফ বড় বড় ছাহাবাদিগকেও অভিভূত করে। এমনকি হযরত উমর ফারুক্ব আলাইহিস সালামও উনার বিছাল শরীফের খবর বিশ্বাস করতে পারেননি। তিনি উন্মুক্ত তরবারী হাতে বলতে লাগলেন, যে বলবে যে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার বিছাল শরীফ সম্পন্ন হয়েছে আমি তাকে এই তরবারী দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করব।

হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উনাকে শান্ত করতে সমর্থ হলেন। তিনি কুরআন শরীফের এই বাণী পড়ে শুনালেন, ‘‘মুহম্মদ (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ পাক-উনার রসূল, উনার পূর্বেও রসূলগণ বিগত হয়েছেন। সুতরাং যদি তিনি বিছাল শরীফ লাভ করেন অথবা শাহাদাত লাভ করেন তবে তোমরা কি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে? কেহ যদি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে সে আল্লাহ পাক-উনার কিছুই ক্ষতি করে না এবং আল্লাহ পাক কৃতজ্ঞগণকে পুরুস্কৃত করবেন’’।

হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উনার এই আয়াত শরীফ পাঠের সঙ্গে সঙ্গে ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের চেতনা ফিরে আসে। হযরত উমর ফারুক্ব আলাইহিস সালাম পর্যন্ত মন্তব্য করেছেন, আমার নিকট মনে হল- এই আয়াত শরীফগুলি এই মাত্র নাযিল হয়েছে। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিছাল শরীফ-এর পর ছাহাবায় কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ অনতিবিলম্বে সর্ব সম্মতিক্রমে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব্ব আলাইহিস সালাম উনার উপর খিলাফতের ভার অর্পন করলেন। অত:পর তিনি সমগ্র মুসলিম জাহানের খলীফা নিযুক্ত হন এবং যোগ্যতা ও সুনামের সাথে খিলাফতের স্তম্ভে সর্বমোট দু’বছর তিন মাস দশ দিন খিলাফত পরিচালনা করেন। এই অল্প সময়ের মধ্যে সকল প্রকার বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্র সাফল্যের সাথে দমন করে তিনি সমগ্র মুসলিম জাহানে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। সুবহানাল্লাহ।

ক্বওল শরীফ ও আমলঃ
মুসলমানের প্রত্যেক কষ্টের ছওয়াব দেয়া হবে। কাঁটা ফুটলে, এমনকি জুতার ফিতা ছিঁড়ে গেলেও মু’মিন তার ছওয়াব পাবে। যে ব্যক্তি আল্লাহ পাক-উনার খালিছ মুহব্বতের স্বাদ পেয়েছে, সেই আস্বাদন শক্তি তাকে দুনিয়ার স্বাদ তালাশ করা হতে বিরত রেখেছে। হক্ব কথা বলা খুবই কঠিন, কিন্তু তা কঠিন সত্ত্বেও আনন্দদায়ক ও প্রশংসনীয়। বাতিল কাজ সহজ হলেও তা নিন্দনীয়।
আয় আল্লাহ পাক! হক্বকে হক্ব অনুসারেই আমাকে দেখান, তাকে অনুসরণ করার তওফিক দিন বাতিলকে বাতিলরূপেই আমাকে দেখান এবং তাকে পরিত্যাগ করার তওফিক দিন। বাতিলকে আমার উপর বিজয়ী করে দিবেন না, যাতে আমি খাহেশ ও কু-প্রবৃত্তির দাস হয়ে পড়ি। (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দিয়া মুজাদ্দেদীয়া)

যে ব্যক্তি ঈদে মীলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনুষ্ঠানের জন্য এক দিরহাম খরচ করবে, সে জান্নাতে আমার বন্ধু হবে। (আন-নি‘মাতুল কুবরা আলা’ল ‘আলাম)

‘মুহীত’ কিতাবে উল্লেখ আছে যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (একবার) মসজিদে তাশরীফ এনে একটি স্তম্ভের নিকট বসেছিলেন। উনার পাশে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম বসেছিলেন। এর মধ্যে হযরত বিলাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আযান শুরু করেছিলেন, যখন ‘‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রসুলুল্লাহ’’ উচ্চারণ করলেন, তখন হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব
আলাইহিস সালাম বৃদ্ধাঙ্গুলীদ্বয়ের নখ্‌ চুম্বন করে আপন দু’চোখের উপর রেখে বললেন, কুর্‌রাতু ‘আইনী বিকা ইয়া রসুলাল্লাহ (হে আল্লাহ পাক-উনার রসুল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি আমার চোখের মণি)। হযরত বিলাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর আযান শেষ হওয়ার পর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম! আপনি যা করেছেন, যে ব্যক্তি তদ্রুপ করবে, আল্লাহ পাক তার সমুদয় গুণাহ্‌ মাফ করে দিবেন। (সুবহানাল্লাহ) (তাফসীরে রুহুল বয়ান)

বিছাল শরীফঃ
হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উনার অন্তিম সময়ে উনার নিকট উপস্থিত লোকেরা উনাকে জিজ্ঞেস করল, আপনার জন্য চিকিৎসক ডাকার ব্যবস্থা করব কি? তিনি বললেন, আমার চিকিৎসক আমাকে পরীক্ষা করে বলেছেন- নিশ্চয়ই আমি যা ইচ্ছা তাই করি। এ সময় হযরত সালমান ফারসী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে দেখতে আসলেন। অসুখের খোঁজ খবর নেয়ার পর তিনি বললেন, হে আবূ বকর! আমাকে কিছু ওছীয়ত করুন!

হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম বললেন, আল্লাহ পাক আপনাদের জন্য দুনিয়া জয় করে দিবেন। আপনি দুনিয়া থেকে প্রয়োজন পরিমাণই গ্রহণ করবেন। আর মনে রাখবেন, যে ব্যক্তি ফযরের নামায আদায় করে, সে আল্লাহ পাকের ওয়াদার মধ্যে থাকে। সুতরাং আল্লাহ পাকের সঙ্গে ওয়াদা ভঙ্গ করবেন না। যদি আল্লাহ পাকের সঙ্গে ওয়াদা ভঙ্গ করেন, তবে উপুড় অবস্থায় দোজখে নিক্ষিপ্ত হতে হবে। লোকেরা উনার অন্তিম সময়ে উনাকে অনুরোধ করল যে, একজনকে আপনার স্থলাভিষিক্ত করে দিন।
তিনি যখন হযরত উমর ফারুক্ব আলাইহিস সালামকে উনার স্থলাভিষিক্ত করলেন। তারা বলল, আপনি একজন কঠোর স্বভাব বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বকে আপনার স্থলাভিষিক্ত করেছেন। আপনি আল্লাহ পাকের নিকট এর কি জবাব দিবেন?
তিনি উত্তর দিলেন- আমি বলব, আল্লাহ পাক আপনার সৃষ্টির মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তিকেই আমি নিজের স্থলাভিষিক্ত করেছি। অতঃপর তিনি হযরত উমর ফারুক্ব আলাইহিস সালামকে ডেকে কিছু ওছীয়ত করলেন। (কিতাবু জিক্‌রিল মাউতি ওয়া মা বা’দাহু)

উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম সূত্রে আল-ওয়াক্বিদী এবং আল-হাকিম বর্ণনা করেন যে, হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম ৭ ই জুমাদাল উখ্‌রা সোমবার গোসল করেন। আর এই দিনটি ছিল শীতল। এর পর ১৫ দিন ধরে উনার জর হয়। এ সময় তিনি মসজিদে জামায়াতে নামায পড়তে পারেননি। হিজরী ১৩ সনে ২২ শে জুমাদাল উখ্‌রা মুতাবিক ২৩ শে আগস্ট, ৬৩৪ ঈসায়ী মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ৬৩ বছর বয়সে তিনি বিসাল শরীফ গ্রহণ করেন। (তারিখুল খুলাফা, কিতাবুল আলক্বাব, ৩য় খন্ড )

বুযুর্গী ও ফযীলতঃ
উনার বুযুর্গী ও ফযীলত বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। স্বভাবগত ভাবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কোমল প্রকৃতির লোক। কিন্তু শরীয়তের বিধান কার্যকর করার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। কালামুল্লাহ শরীফে স্বয়ং আল্লাহ পাক একাধিক স্থানে উনার ছানা-ছীফত করেছেন। উনার প্রশংসায় অসংখ্য হাদীছ শরীফ বর্ণিত হয়েছে। মুদ্দা কথা, নবী রসুল আলাইহিমুস সালামগণের পরে যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী তিনিই ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম এবং এই ছিদ্দীক্বে আকবর লক্বব উনার একক বৈশিষ্ট্য। উনার মর্যাদা স্বল্প পরিসরে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। এমন কোন ভাষা নেই, যে ভাষায় উনার জীবনী গ্রন্থ রচিত হয়নি। তিনি ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন, প্রথম কুরআন শরীফ সংগ্রহ করেন এবং নাম দিলেন মুছহাফ এবং তিনিই প্রথম যাঁকে খলীফা বলে অভিহিত করা হয়েছে।

হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম ইসলাম জগতে এক নজির-বিহীন বিরল ব্যক্তিত্ব। নুবুওওয়াতের পর উনার ইমামত ও খিলাফত সকলেই বিনা দ্বিধায় মেনে নেন। হাদীছ শরীফে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যেই জামায়াতে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উপস্থিত থাকবেন সেখানে তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইমামতি করা উচিত হবে না। (তিরমিযী শরীফ)

তিনি আরো ইরশাদ করেন, আমি আমার রব (আল্লাহ পাককে) ছাড়া যদি আর কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম তাহলে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালামকেই বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম। (মুয়াত্তা শরীফ)

মুয়াত্তা শরীফে আরো বর্ণিত হয়েছে, একদা জনৈক মহিলা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার নিকট এসে কোন বিষয়ে কথাবার্তা বলল। তিনি তাকে পুণরায় আসতে বললেন, তখন মহিলাটি বলল- ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি আবার এসে যদি আপনাকে না পাই, তখন কি করব? উত্তরে তিনি বললেন, তুমি যদি আমাকে না পাও, তবে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উনার নিকট এস। রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তিনি আমার (ছওর) গুহার সঙ্গী এবং হাউযে কাউছারে আমার সাথী। (তিরমীযী শরীফ)

নূরে মুজাস্‌সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার ছওর গুহার সঙ্গী হওয়ার বিষয়টি মহান আল্লাহ পাক উনার কালাম পাকে উল্লেখ করেছেন। এর ফযীলত বর্ণনা প্রসঙ্গে স্বয়ং হযরত উমর ফারুক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, আমার সারা জীবনের আমল যদি হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর সেই রাত্রির আমলের সমান হত! তা সেই রাত্রি, যেই রাত্রিতে তিনি (হিজরতের সফরে) হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সঙ্গে ছওর গুহার দিকে রওয়ানা হন। (রযীন)

হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উনার সবকিছু আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার জন্য কুরবান করে উম্মতের জন্য কিয়ামত পর্যন্ত এক উজ্জল আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। তাবুকের জিহাদের সময় চরম আর্থিক অনটন সত্ত্বেও তিনি উনার সকল গৃহ সামগ্রী হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সামনে নিয়ে উপস্থিত করেন। সন্তান সন্ততির জন্য কি রেখে এসেছেন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন যে, আল্লাহ পাক ও উনার রসুলকে রেখে এসেছি। (আবূ দাউদ শরীফ)

হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম ছিলেন একজন ধনী ব্যবসায়ী। যেদিন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, সেদিন উনার বাড়ীতে চল্লিশ হাজার দিরহাম বা দিনার ছিল, আর হিজরতের সময় যখন তিনি মদীনা শরীফ রওয়ানা হন, তখন উনার নিকট পাঁচ হাজার দিনার বা দিরহামের অধিক ছিল না। এই সব অর্থ তিনি গোলাম আযাদ ও দ্বীন ইসলামের জন্য ব্যয় করেছিলেন। (তারীখুল খুলাফা)

হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যিনি সকল মানুষের মধ্যে আমাকে প্রাণ ও সমপদ দিয়ে সর্বাধিক দায়বদ্ধ করে ফেলেছেন, তিনি হলেন হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম। আমি যদি আমার রব (আল্লাহ পাক) ছাড়া অন্য কোন বন্ধু গ্রহণ করতাম, তবে নিশ্চয়ই সে হত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম। কিন্তু মুমিনদের ভ্রাতৃত্বই আমার জন্য যথেষ্ট। (তারীখুল খুলাফা)


তরীক্বতের ইমাম হযরত দাতা গঞ্জে বখ্‌শ রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ পাক কাউকে যখন পূর্ণ সততা দান করেন, তখন তিনি সর্বক্ষণ আল্লাহ পাকের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকেন এবং আল্লাহ পাক তাকে যখন যে অবস্থায় রাখেন তাতেই সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। যদি ফকীর হওয়ার নির্দেশ দেন, অমনি অম্লান বদনে ফকীর হয়ে যান। আর যদি আমীর হওয়ার নির্দেশ দেন তবে আমীর হয়ে যান। তিনি আপাদমস্তক আল্লাহ পাকের নির্দেশের সম্মুখে মাথা নত করে দেন। এই অবস্থাই ছিল হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালামের। এমনকি তিনি ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, উনার দ্বারা কোন অন্যায় কাজ সংঘটিত হলে কেউ যেন উনার অনুগত না থাকে। এই কারণে তিনি তরীক্বতের স্বয়ং সমপূর্ণ ইমাম ছিলেন। (কাশফূল মাহযুব)

হযরত মাওলানা শাহ আবদুল আজিজ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কিতাব “তোহ্‌ফায়ে ইছ্‌না আশারিয়া’’ কিতাবে লিখেছেন- হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ পাক যা কিছু আমার হূদয়ে নিক্ষেপ করেছেন, আমি তৎসমুদয় হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উনার হ্নদয়ে নিক্ষেপ করেছি। (তাছাউফ তত্ত্ব)

নক্‌শবন্দীয়া-মুজাদ্দিদীয়া তরীকার নিসবত উনার মাধ্যমেই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সাথে সম্পর্কিত।

তথ্যসূত্র সমূহঃ তারিখূল খোলাফা, কিতাবুল আলক্বাব, কাশফুল মাহযূব, জামেউ কারামাতে আওলিয়া, তফসীরে মাজহারী, হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া, কিতাবু জিকরিল মাওত ওয়ামা বা‘দাহু, সীরত গ্রন্থসমূহ।

আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালাম উনার সংক্ষিপ্ত জীবনী মুবারক

পরিচিতিঃ
উনার নাম উমর, উপনাম আবূ হাফ্‌স্‌। বিশেষ উপাধি ফারূক্ব। পিতার নাম খত্তাব, মাতার নাম খাতনা মতান্তরে হানতামা বিনতে হাশিম ইবনে মুগিরা। উনার ৮ম পুরুষের ক্রমধারা এসে হযরত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সঙ্গে মিলে যায়। তিনি কুরাইশ বংশের দ্বিতীয় শাখা বনু আদী গোত্রভূক্ত ছিলেন। আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালাম হিজরতের ৪০ বছর পূর্বে রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার বিলাদত শরীফের ১৩ বছর পর ৫৮৩ ঈসায়ী সনে যমীনে আগমন করেন।

তিনি গৌরবর্ণ, দীর্ঘকায় এবং স্থূলদেহী ছিলেন। বাম হাত দ্বারা তিনি ডান হাতের ন্যায়ই কাজ করতে পারতেন। তিনি ধাবমান ঘোড়ার পিঠে লাফ দিয়ে আরোহণ করতে পারতেন। তিনি জাহেলী যুগে ‘‘উকাজ’’ মেলায় মল্লভূমিতে কুস্তিও লড়তেন। (ইবনে সা’দ)

ইসলাম গ্রহণঃ
তিনি আনুষ্ঠানিক নুবুওয়াত প্রকাশের ৫ম সালে ২৭ বছর বয়সে ইসলাম কবুল করেন। উনার দ্বারা মুসলমানদের সংখ্যা চল্লিশ পূর্ণ হয় অর্থাৎ তিনি চল্লিশতম মুসলমান। উনার ইসলাম গ্রহণের পরই ইসলাম প্রকাশ্যে ময়দানে নেমে আসে। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার যুগে প্রথম দিকে তিনি ইসলামের পক্ষে ছিলেন না এবং ইসলাম গ্রহণকারীদের বিশেষ করে স্বীয় গোত্রের নও মুসলিমদের নির্যাতন করতেন। উনার ইসলাম গ্রহণ সমন্ধে বর্ণিত আছে যে, প্রথমতঃ তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে শহীদ করার উদ্দেশ্যে বের হন এবং পথিমধ্যে একজন আত্মীয় তাঁকে বলেন: নিজের ঘর অর্থাৎ ভগ্নি ও ভগ্নিপতির সংবাদ নিন। অতঃপর তিনি সোজা ভগ্নিপতির বাড়ীর দরজায় উপস্থিত হয়ে ঘরে কুরআন শরীফ পাঠের আওয়াজ শুনতে পান। ঘরে ঢুকে তিনি বোন ও বোনের জামাতাকে ভীষণ প্রহার করেন। পরে উনারা কি পড়ছিলেন তা দেখতে চান।

অতঃপর পবিত্র কুরআন শরীফের ‘সুরা ত্ব-হার’ একটি আয়াত শরীফ পড়ে উনার অন্তর দ্রবিভূত হয়ে যায় এবং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার দরবার শরীফে এসে মুসলমান হয়ে যান। সে সময় মুসলমানগণ আল্লাহ পাকের প্রশংসা করে এমন ‘‘তাকবীর’’ ধ্বনি উচ্চারণ করেছিল যে, মক্কা শরীফের সংকীর্ণ গিরিপথেও তা শোনা গিয়েছিল।

খিলাফতের দায়িত্ব লাভঃ
খলীফাতু রসূলিল্লাহ, হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উনার বিছাল মুবারকের পর হিজরী ১৩ সালের ২৩ শে জুমাদাল উখ্‌রা মুতাবিক ২৪ শে আগস্ট ৬৩৪ ঈসায়ী সালে খিলাফতর লাভ করেন।

খলীফাতু রসূলিল্লাহ, হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উনার দাফন মুবারক সমাধা করার পর হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালাম উপস্থিত জনগণকে সম্মোধন করে বলেন, তোমাদের দ্বারা যেমন আমাকে পরীক্ষা করা হচ্ছে, তেমনি আমার দ্বারা তোমাদেরকে পরীক্ষা করা হচ্ছে। আমি আমার পূর্ববর্তী দু’জন মহান ব্যক্তিত্বের পরে তোমাদের মধ্যে স্থলাভিষিক্ত হয়েছি। এ মদীনা শরীফে আমাদের সম্মুখে যা কিছু ঘটবে তা আমরা নিজেরাই সমাধা করব। আর যা মদীনা শরীফের বর্হিদেশে ঘটবে তা সমাধা করার জন্য উপযুক্ত, শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত লোকদেরকে নিযুক্ত করব। যিনি সুষ্ঠু ভাবে স্বীয় কর্ত্তব্য পালন করবেন উনাকে পুরুস্কৃত করা হবে। আর যে অন্যায়ের আশ্রয় গ্রহণ করবে তাকে শাস্তি প্রদান করা হবে। আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে ক্ষমা করুন। (ইবনে সা’দ)


উনার খিলাফতকাল সর্বমোট ১০ বছর ৬ মাস স্থায়ী হয়। খলীফাতু রসূলিল্লাহ, হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালাম উনার খিলাফতকালে মিশরে কৃষিকার্য নীলনদের বার্ষিক প্লাবনের উপর নির্ভরশীল ছিল। মুসলমানগণ প্রাচীন বর্বর প্রথা দেখতে পায় যে, একটি খুবছূরত কুমারী বালিকাকে নীলনদে বিসর্জন দেয়ার উদ্দেশ্যে জীবিতাবস্থায় নিমজ্জিত করা হতো। এ সংবাদ পাওয়া মাত্রই হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালাম উহা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ঘটনাক্রমে সে বৎসর আবিসিনিয়ায় কিছু বিলম্বে বৃষ্টি হয় এবং সে বৎসর নীলনদের প্লাবন আসলো না। কুসংস্কারাছন্ন অমুসলমান কৃষকগণ এতে অস্থির হয়ে পড়ে। এ সংবাদ পেয়ে হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালাম নীলনদকে সম্বোধন করে একটি চিঠি মিসরে প্রেরণ করেন: হে নীলনদ! যদি তোমার স্বীয় ইচ্ছায় চলাচল কর, তা হলে এসো না, আমাদের তোমার প্রয়োজন নেই। যদি আল্লাহ পাক-উনার কুদরতে তোমার প্লাবন হয় তা হলে আমি আল্লাহ পাক-উনার নিকট দোয়া করছি যে, তিনি যেন প্লাবন প্রেরণ করেন। মিশরের গভর্ণর এ চিঠি নীলনদে ফেলে দিলেন। পরবর্তী দিনই প্রভাতে পানির উচ্চতা ১৬ হাত হয়ে নদীতে প্লাবন আসে। (ইবনে কাছীর: আল-বিদায়া)

অন্য বর্ণনায় এসেছে, চিঠিটি নীলনদের যমীন স্পর্শ করা মাত্রই এক লাফে ১৬ হাত পানি নীলনদে চলে আসলো।

আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালাম একটি সৈন্য বাহিনী পাঠালেন এবং তাদের উপর সারিয়া নামে এক ব্যক্তিকে সেনাপতি নিযুক্ত করলেন। তিনি শুক্রবারে জুমুয়ার খুতবা দিচ্ছিলেন। খুত্‌বার মধ্যে থাকাকালীন হঠাৎ বলে উঠলেন, ইয়া সারিয়াতা আল-জাবাল- হে সারিয়া! পাহাড়! পরবর্তীতে উক্ত সৈন্য বাহিনী হতে একজন দূত এসে বললো, হে আমিরুল মুমেনীন! আমরা শত্রু পক্ষের সম্মুখীন হয়েছিলাম। তারা আমাদেরকে পরাজিত করে দিচ্ছিল। আমরা হঠাৎ একটি আওয়াজ শুনতে পেলাম, হে সারিয়া! পাহাড়। আমাদের পেছনে একটি পাহাড় ছিল। ঐ পাহাড়ের পেছন হতেই শত্রু সৈন্য এসে আমাদেরকে পরাস্ত করতে চেয়েছিল। আমরা এক যোগে সে পাহাড়ের দিকে গিয়ে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অত:পর তারা পরাজিত হলো। (মিশকাত, বায়হাকী)

আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালাম উনার জীবন যাপন আশ্বর্য্যজনক ভাবে সাধারণ ছিল। একদিন দ্বিপ্রহরে দূরবর্তী ভ্রমণে তন্দ্রা আসলে তিনি একটি বৃক্ষের নীচে বিনা বিছানায় শুয়ে নিদ্রায় মগ্ন হন। ঘটনাক্রমে তথায় রোম সম্রাটের দূত আগমন করেন এবং প্রশাসন ভবনে উনাকে না পেয়ে জিজ্ঞেস করতে করতে যেখানে তিনি নিদ্রায় মগ্ন ছিলেন সেখানে পৌঁছেন এবং হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালামকে বৃক্ষের নীচে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে হঠাৎ বলে উঠল, আমার মনিব জালিম এজন্য ভয়ের কারণে প্রহরা ব্যতীত কোথাও থাকতে পারেন না। আর আপনি ন্যায় বিচার ও ইনছাফ করেন যার ফলে এ রকম নিশ্চিন্তভাবে বৃক্ষের নীচে নিদ্রা যেতে পারেন যে, কোন প্রহরীরও প্রয়োজন হয় না।

উনার খিলাফত আমলে অমুসলিমদের প্রতিও কতটা ন্যায়পরায়নতা অবলম্বন করা হতো, নিম্নের ঘটনা থেকে তা উপলব্ধি করা যায়। একবার রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের প্রবল প্রতিরোধমূলক আক্রমনের দরুন কতক অগ্রসরমান মুসলমান সৈন্যকে পশ্চাতে হটিয়ে যুদ্ধমান সৈন্যদের সংখ্যা বৃদ্ধি করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এ উদ্দেশ্যে হিম্‌স্‌ শহরবাসীদের অন্যত্র সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। বিদায়কালে মুসলিম সেনানায়ক তথায় আদায়কৃত সমস্ত জিযিয়া কর স্থানীয় অমুসলিম এবং শত্রু প্রজাদেরকে ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, করের বিনিময়ে নিরাপত্তা প্রদান করা কর্তব্য। এখন আমরা তোমাদেরকে নিরাপত্তা প্রদান করতে অক্ষম বিধায় তোমাদের সমপদও আমরা গ্রহণ করতে পারি না। হিম্‌স্‌ বাসীগণ অশ্রু বর্ষণ করে তাঁদেরকে বিদায় দেয় এবং শীঘ্র প্রত্যাবর্তনের প্রার্থনা জানায়। (আবূ ইউসূফ, বালাজুরী, ফুতুহ)

রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার পরিবারের সাথে উনার সম্পর্কঃ
নূরে মুজাস্‌সাম, হাবীবুল্লাহ রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সাথে দ্বীনী সম্পর্কই একজন ছাহাবীর মূখ্যতম সম্পর্ক, তা সত্ত্বেও হযরত উমর ফারূক্ব্ব আলাইহিস সালাম রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্কেও ধন্য হয়েছিলেন। স্বীয় কন্যা উম্মুল মুমিনীন হযরত হাফ্‌সা আলাইহাস সালামকে রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার খিদমতে হাদিয়া দেন। রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার নাত্‌নী হযরত উম্মে কুলসুম বিনতে ফাতিমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমাকে হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালাম গ্রহণ করেন, আহলে বাইতদের সাথে নিসবত (সম্পর্ক) স্থাপনের উদ্দেশ্যে।

হযরত উমর আলাইহিস সালাম উনার অন্তরে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আহলে বাইত গণের প্রতি মুহব্বতঃ
আখিরী রসুল, সায়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিয়্যীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘‘যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা তোমাদের মাতা-পিতা, স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি এমনকি নিজের জীবনের চেয়েও আমাকে বেশী মুহব্বত না করবে, ততক্ষণ তোমাদের কেউ হাক্বীক্বী মু’মিন হতে পারবে না’’।

এ কথা শুনে হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালাম বললেন, ইয়া রসুলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি আমার পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ধন-সম্পত্তি সব কিছু থেকে আপনাকে বেশী মুহব্বত করে থাকি, কিন্তু এখনো আমার জানের চেয়ে বেশী মুহব্বত করতে পারিনি। এ কথা শুনে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, ‘‘না, তাহলে আপনিও এখনো হাক্বীক্বী মু’মিন হতে পারেন নি’’।
এ কথা শুনে হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালাম বাচ্চা শিশুর মত কাঁদতে লাগলেন। আল্লাহ পাক-উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালাম উনাকে নিকটে ডেকে উনার সিনায় হাত মুবারক রেখে ফয়েজে ইত্তেহাদী দিলেন। অত:পর হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালাম বললেন, এখন আমার মত হাজার হাজার নয়, বরং কোটি কোটি উমর আপনার জন্যে জীবন কুরবান করতে প্রস্তুত আছি । (সুবহানাল্লাহ)

একবার হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনার পিতা ও তৎকালীন খলীফা হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালাম উনার নিকট জানালেন যে, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনাকে ‘‘গোলামের ছেলে গোলাম’’ বলেছেন। হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালাম ইহা শুনে বললেন, ঠিক আছে এটার ফায়ছালা হবে। তিনি নির্ধারিত সময়ে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম ও অন্যান্য মান্যগণ্য লোকদেরকে উনার নিকট উপস্থিত হওয়ার জন্য খবর দিলেন। সকলে খলীফার দরবারে উপস্থিত হলেন। সকলের উপস্থিতিতে তিনি হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি আমার ছেলে, আবদুল্লাহকে ‘‘গোলামের ছেলে গোলাম’’ বলেছেন হযরত ইমাম হুসাইনআলাইহিস সালাম  বললেন- হাঁ, বলেছি।

হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালাম বললেন, আপনি কি এ কথা কাগজে লিখে দিতে পারেন ? তিনি উক্তর দিলেন- হাঁ, লিখে দিব। এই বলে তিনি এক টুকরা কাগজে লিখে দিলেন, আবদুল্লাহ ইবনে উমর গোলামের ছেলে গোলাম। হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালাম উক্ত কাগজের টুকরোকে হাতে নিয়ে চুমা দিলেন এবং সবাইকে নির্দ্দেশ দিলেন, তোমরা আমার মৃত্যুর পরে কাফনের সঙ্গে এ কাগজটি রেখে দিবে।
আমি যে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার গোলাম এটাই উনার প্রমাণ। এ অবস্থা দেখে সবাই আশ্চর্য্যান্বিত হলেন। এ থেকে বুঝা যায় তিনি আহলে বাইতের প্রতি কতটা মুহব্বত, শ্রদ্ধা ও ভক্তি রাখতেন। (সওয়ানেহে হযরত উমর ফারূক্ব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু, সওয়ানেহে হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু আনহু)

শাহাদতবরণঃ
হিজরী ২৩ সালের ২৪শে জিলহজ্জ ইয়াওমুল আরবিয়ায়ি (বুধবার) দিন মসজিদে নববী শরীফে ফজরের নামাযে ইমামতী করার জন্য দাঁড়ালে হযরত মুগিরা ইবনে শু‘বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার দাস আবূ লূলূ বিষাক্ত তরবারি দ্বারা উনাকে মারাত্মকভাবে আঘাত করে। আহত অবস্থায় তিন দিন অতিবাহিত হওয়ার পর ২৭শে জিলহজ্জ শনিবার তিনি শাহাদত বরণ করেন।

দাফন ও নামাযে জানাযাঃ
হযরত ছুহাইব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার জানাযার নামায পড়ান। রওযায়ে নববী শরীফের মধ্যে হযরত ছিদ্দীকে আকবর আলাইহিস সালাম উনার বাম পাশে উনাকে দাফন করা হয়। শাহাদতকালে উনার বয়স হয়েছিল ৬৩ বৎসর ।

ফযীলত ও মর্যাদাঃ
ফারূক্বে আ‘যম হযরত উমর আলাইহিস সালাম উনার ফযীলত ও মর্যাদা সম্পর্কে পবিত্র কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফে এত বেশী ইঙ্গিত ও প্রকাশ্য বাণী রয়েছে যে, সংক্ষিপ্ত কোন প্রবন্ধে তা প্রকাশ করা যাবে না। আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনাদের নিকট উনার স্থান অতি উর্ধ্বে। এজন্য বলা হয়েছে, হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালাম উনার মতের সমর্থনে বা প্রস্তাবনায় পবিত্র কুরআন শরীফে ২২টিরও বেশী আয়াত শরীফ নাযিল হয়েছে ।

হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম বলেন, ‘‘হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম, তারপর হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালাম’’।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, “হযরত উমর ফারূক্ব আয’ম আলাইহিস সালাম উনার ইসলাম গ্রহণ ইসলামের বিজয়। উনার হিজরত মহান আল্লাহ পাক-উনার সাহায্য এবং উনার খিলাফত মহান আল্লাহ পাক-উনার রহমত”।

হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালাম উনার যাবতীয় গুণাবলী লক্ষ্য করেই রসূল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, ‘‘আমার পরে কেউ নবী হলে হযরত উমর আলাইহিস সালামই হতেন’’। কারণ উনার মধ্যে ছিল নবীদের স্বভাব-বৈশিষ্ট্য।

হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালাম ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা। তবে উনাকে সর্বপ্রথম ‘আমীরুল মু’মিনীন’ বলা হতো। কেননা, হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালামকে ‘খলীফাতু রসূলিল্লাহ’ বলা হতো।

তিনিই সর্ব প্রথম হিজরী সন প্রবর্তন করেন, তারাবীহ্‌র নামায জামায়াতে পড়ার ব্যবস্থা করেন, মেয়েদের জামায়াত নিষিদ্ধ করেন, জন শাসনের জন্য দুর্‌রা বা চাবুক ব্যবহার করেন, মদপানে আশিটি বেত্রাঘাত নির্ধারণ করেন, বহু রাজ্য জয় করেন, নগর পত্তন করেন, সেনাবাহিনীর স্তরভেদ ও বিভিন্ন ব্যাটালিয়ান নির্দিষ্ট করেন, জাতীয় রেজিষ্টার বা নাগরিক তালিকা তৈরী করেন, কাযী নিয়োগ করেন এবং খিলাফত অধীনস্থ এলাকাকে বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত করেন।


তথ্যসূত্র সমূহঃ তারিখূল খোলাফা, কিতাবুল আলক্বাব, কাশফুল মাহযূব, জামেউ কারামাতে আওলিয়া, তফসীরে মাজহারী, হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া, কিতাবু জিকরিল মাওত ওয়ামা বা‘দাহু, সীরত গ্রন্থসমূহ।